খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির স্বার্থে মিলিং
ব্যবস্থাপনার জনসচেতনতা
মোঃ কাওছারুল ইসলাম সিকদার
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ধান উৎপাদনকারী দেশ। এ দেশের জলবায়ু মাটি ও পানি ধান চাষের জন্য উপযোগী। একসময় এদেশে অসংখ্য জাতের ধানের আবাদ ছিল। উচ্চফলনশীল জাতের আবির্ভাব হওয়ায় স্থানীয় মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত আদি জাতসমূহের বিলুপ্তি ঘটেছে। স্থানীয় জাতের ধানের উৎপাদন ক্ষমতা কম কিন্তু উৎপাদনকাল বেশি ছিল। তবে পুষ্টিগুণ ছিল অধিক। বর্তমানে যে সকল ধানের চাষাবাদ করা হয় এদের উৎপাদনে সময় কম লাগছে কিন্তু ফলন বেশি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা বিবেচনায় উচ্চফলনশীল ধানের জাতের পর হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদের দিকেও ঝুঁকছে এদেশের কৃষক। প্রযুক্তির আশীর্বাদ আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। নতুবা দেশে খাদ্য ঘাটতির সৃষ্টি হবে, মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগবে এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি রক্ষাই হলো সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারনে অধিক ধান উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার হচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক মিলিং ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ নির্দেশনার অনুপস্থিতির কারণে আধুনিক চালকলের অতিরিক্ত পলিশিং ব্যবস্থায় চালের পুষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে। পলিশবিহীন পূর্ণচাল পুষ্টিমানসমৃদ্ধ কিন্তু দেখতে আকর্ষণীয় নয়। অনেকটা ঘোলা বা বাদামি ধরনের। তাই এই চালের বাজারদর নিম্ন এবং চাহিদা কম। অতিরিক্ত পলিশিং ব্যবস্থায় চালের উপরের বাদামিস্তর চলে যাচ্ছে এবং স্বচ্ছ ও সিল্কি চাল তৈরি হচ্ছে। এ সিল্কি চাল আকর্ষনীয় ও বাজারে এর চাহিদাও বেশি। সেইসাথে দামও অধিক অথচ বাদামি চালের পুষ্টির তুলনায় স্বচ্ছ চালের পুষ্টিমান অনেক কম। স্বচ্ছ ও সিল্কি চালে কার্বোহাড্রেট বেশি থাকে তাই ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে বাজারে যে চাল পাওয়া যায় তা ১০ শতাংশেরও অধিক পলিশিংযুক্ত। এই অতিরিক্ত পলিশিংয়ের কারণে প্রতি বছর প্রায় পঞ্চাশ লাখ মেট্রিকটন চালের অপচয় হচ্ছে। পলিশিং যদি ৫% এ সীমাবদ্ধ রাখা যায় তবে ২৫ লাখ মেট্রিক টন চালের সাশ্রয় হবে। অধিক মাত্রায় পলিশিংয়ের কারণে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে ও বৈদেশিক উৎস হতে মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল ও গম আমদনি করতে হচ্ছে অথচ চালকলের পলিশিং ব্যবস্থার উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করে এই অপচয় রোধসহ খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি উভয়টিই নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে অভ্যন্তরীণভাবে দেশে খাদ্যর চাহিদা পূরণ এবং বাজারের দরের স্থিতিশীলতা আসবে। বাজারদর স্থিতিশীল থাকলে সকল শ্রেণীর মানুষের খাদ্য ক্রয়ের সামর্থ্যও উন্নত হবে। যেহেতু কম পলিশযুক্ত চাল পুষ্টিসমৃদ্ধ ও ফাইবারযুক্ত, তাই পূর্ণচাল ভোগে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থারও উন্নয়ন ঘটবে। অপুষ্টিজনিত রোগবালাই কমবে এবং স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি ও এখাতে ব্যয় হ্রাস পাবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত পলিশিংয়ের কারণে চালের স্থায়িত্বও কমে যায়। বাজারে কিছু একসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ চাল দেখা যায় যেগুলোর পেট সাদা। এসব চাল একসিদ্ধ বলা হলেও পুরোপুরি একসিদ্ধও নয়। এসকল চাল দ্রুত ভেঙে যায় এবং স্থায়িত্ব কমে যায়। যার কারণে চালের অপচয় হয়। তাই চাল হতে হবে পুরোপুরি সিদ্ধ নতুবা সিদ্ধহীন আতপ। ধান হতে চাল তৈরিতে কখনো দুই সিদ্ধ আবার কখনো একসিদ্ধ করা হয়। ধানকে যখন সিদ্ধ করা হয় তখন চালের উপরের পুষ্টিযুক্ত স্তর হতে কিছু পুষ্টি চালের ভিতরের স্তরে পৌঁছে যায়। এ কারণে আতপের তুলনা সিদ্ধ চালের পুষ্টিমান তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। একই কারণে একসিদ্ধ চালের তুলনায় দুইসিদ্ধ চাল বেশি পুষ্টিমানসমৃদ্ধ।
আধুনিক মিলিং ব্যবস্থা মূলত বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়। যার কারণে সয়ংক্রিয়ভাবে এসব মিলে চাল শুকানো, সিদ্ধকরণ, মিলিং করা, মরা ও ভাঙা দানা পৃথকীকরণসহ চাল বহির্ভূত অন্যান্য বিজাতীয় পদার্থ আলাদাকরণ করা সম্ভব হচ্ছে। ধান হতে চাল তৈরির জন্য প্রাকৃতিকভাবে অনুকূল পরিবেশের জন্য আগের মতো অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে ধান ভিজে নষ্ট হওয়া হতে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে অটোমেটিক মিলিং ব্যবস্থার ধান হতে চাল তৈরিতে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার প্রভাব থাকছে না বিধায় দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ছে, চালের গুণগতমানও অক্ষুণœ থাকছে। সেইসাথে কাক্সিক্ষত মানের চাল তৈরি ও ভোক্তার সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে।
আগের ভোক্তা পর্যায়ে মরা দানা, ভাঙা দানা ও অন্যান্য বিজাতীয় পদার্থ চাল হতে পৃথক করতে হতো। পূর্বে হলারের মধ্যমে যে মিলিং হতো তাতে নির্দিষ্ট জাতের বা ধরনের চাল পৃথক করে রাখা সম্ভব হতো। বর্তমানে বড় মিলে সেটি আর সম্ভব নয় বলেই অনুমেয়। কারণ মেজর বা অটোমেটিক চালকলে বেশ কয়েক টন ধান একইসাথে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ ধান অসংখ্য কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেই ফরিয়ার মাধ্যমে চালকলে আনা হয়। তাই এতে বিভিন্ন জাতের ধান থাকাই স্বাভাবিক। সে কারণে বাজারে চালের বস্তায় যে ধরনের চাল বলে উল্লেখ করা হয়, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই যথার্থ নয়। তবে নির্দিষ্ট কিছু উচ্চমূল্যের সরু বা পোলাউর চালে স্বকীয়তা বজায় থাকে। মূলত বিভিন্ন জাতের ধান একই চাল কলে মিলিংয়ের জন্য সংগ্রহ করা হয় এবং মিলার ধান হতে চাল তৈরি করে ক্রেতাদের চাহিদানুযায়ী নামকরণ করেন। এ সমস্যা সমাধানে জোনভিত্তিক নির্দিষ্ট জাতের ধানের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা যেতে পারে। জোনভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থা গৃহীত হলে একদিকে উৎপাদন বাড়বে কারণ ওই এলাকার উপযোগী অধিক উৎপাদনশীল ধান উৎপাদনের জন্য বিবেচিত হবে। সেইসাথে মিলার নির্ধারিত জাতের ধান সংগ্রহ, মিলিং ও এর যথাযথ লেভেলিং বা বস্তায় স্টেনসিলের মাধ্যমে তা বাজারজাত করতে সক্ষম হবেন।
ধানের মধ্যে বেশ কয়েকটি স্তর রয়েছে। যার মধ্যে হাস্ক বা তুস সর্ব-উপরের স্তর, এটি প্রায় ধানের ২০ শতাংশ। এ ছাড়া তুসের নিচের লাল স্তর বা কুড়া যা ৮-১২ শতাংশ। আর মিল রাইছ বা সাদা চাল হলো প্রায় ৬৮-৭২ শতাংশ। মূল চালের উপরের স্তরের ১০-১৫ শতাংশ ফেলে দিয়ে আধুনিক চাল কলের পলিশিং ব্যবস্থায় পৃথক করে সরু ও সাদা চাল তৈরি করা হচ্ছে। আধুনিক মিলিং প্রযুক্তি চালুর পূর্বে মানুষ ঢেঁকিছাঁটা চাল খেতো। ঢেঁকিছাঁটা চাল ছিল লাল কারণ চালের উপরের লাল স্তর এতে অক্ষুণœœ থাকত। চালের উপরের লাল স্তরে তেল ও পুষ্টি থাকে। ঢেঁকিছাঁটা ব্যবস্থার পরবর্তী সংস্করণ হলো হলারের মাধ্যমে ধান ছাটাই। এ মেশিনে উৎপাদিত চালের লাল স্তরের অস্তিত্ব পুরোপুরি না থাকলেও আংশিক বজায় থাকে। সেইসাথে চালের উপরের স্তর ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় চালে পুষ্টি ও ফাইবার দুটোই অক্ষুণœ থাকে। বর্তমানে মেজর বা অটোমেটিক রাইছ মিল চালু হয়েছে, তাতে চালের উপরের লাল স্তরতো থাকেই না বরং মূল চালের উপরের পুষ্টিযুক্ত স্তরটিও পলিশিং করে পৃথক করা হয়। দেশের মানুষের সরু চালের প্রতি আগ্রহ ও চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া বর্তমান প্রজন্ম সাদা চালের সাদা ভাত খেতে পছন্দ করে। ফলে তারা চালের স্বাভাবিক পুষ্টি হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণেই বর্তমানে শিশুদের মাঝে ডায়াবেটিস, দৃষ্টিহীনতা ও অপুষ্টি, কোষ্ঠকাঠিণ্যতাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি বাসা বাধঁছে। তাই বর্তমান প্রজন্মকে রক্ষায় এবং সুস্থসবল কর্মক্ষম জাতিগঠনে চালের পুষ্টি যাতে অক্ষণœ থাকে সেজন্য যথাযথ মিলিং ও বিপণন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের দেশের মানুষ ভাতের মার ফেলে দেয় ভাতকে ঝরঝরা রাখার জন্য। অথচ ভাতের মার ফেলে দেওয়ার কারণে অনেক পুষ্টি হারিয়ে যায়। এছাড়া চাল অতিরিক্ত ধৌত করার কারণেও চালের পুষ্টিমান ক্ষুণœ হয়। মিলে বা চালকলে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার চাল তৈরি ও ভোক্তা সাধারণ কর্তৃক সাদা ঝরঝরে ভাত গ্রহণের কারণে একদিকে চালের ঘাটতি ও আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে, অপরদিকে পুষ্টিহীন চাল গ্রহণ করে এদেশের মানুষ অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন।
খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এবং চালের অপচয় রোধকল্পে দক্ষিণ কোরিয়াতে একসময় চালের পলিশিং নিষিদ্ধ ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও মাত্র ৫% পলিশিং করা হয়। তাই প্রাকৃতিক দূর্যোগপূর্ণ আমাদের এই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে আমাদের প্রয়োজন আশু মিলিং ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা। একদিকে সজ্ঞানে চালকে অতিরিক্ত পলিশিং করে পুষ্টিহীন করা হচ্ছে অপরদিকে বিদেশ হতে ভিটমিন ও মিনারেলযুক্ত কেমিকেল কিনে তা দিয়ে কৃত্রিমভাবে চাল তৈরি করে বিদ্যমান চালের সাথে মিশিয়ে দেশের গরিব মানুষের পুষ্টি পূরণের চেষ্টা চলছে। যা দেশি ও বিদেশী অর্থের অপচয় হচ্ছে। এ অবস্থা হতে উত্তোরনে আমাদের প্রয়োজন যুগপযোগী মিলিং ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা। মিলারগণ যাতে নির্দিষ্ট মাত্রার অধিক চাল পলিশিং করতে না পারেন এবং ক্রেতারাও যেন বেশি দামে পুষ্টিহীন চাল ক্রয় করে প্রতারিত না হন সেলক্ষ্যে আশু মিলিং ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : kawseru11173@gmail.com